বাঙালির চিরকালের শ্রেষ্ঠ হানিমুন ডেস্টিনেশনগুলির মধ্যে দিঘা-পুরী-দার্জিলিং অর্থাৎ ‘দিপুদা’ জনপ্রিয় হলেও নির্জনতার অভাব রয়েছে সেখানে। তাই নির্জন কোনও দ্বীপ বা সমুদ্র সৈকতের খোঁজে মানুষ এখন বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছেন। সে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো হোক বা মধুচন্দ্রিমা, বিদেশি সৈকতগুলোই পর্যটক আকর্ষণের মূল ঘাঁটি হয়ে উঠছে। আর তার খরচ তো অনেকেরই হাতের নাগালের বাইরে। কিন্তু ওই যে বলে না, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু”, আমাদের দেশেই এমন সব অসাধারণ সমুদ্র সৈকত রয়েছে যাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মাথা ঘুরিয়ে দেবে। মলদ্বীপ নিয়ে টানাপড়েনের সময় এখন অনেকেই বিদেশি দ্বীপের মায়া কাটিয়ে দেশের সৈকতগুলোতে যাওয়ার জন্যই টিকিট বুক করছেন। লাক্ষাদ্বীপ তো আছেই, সেই সঙ্গে আরও কিছু এক্সক্লুসিভ ডেস্টিনেশন আছে যেগুলো জেনে নেওয়া ভাল।
সেই কোন ছোট বেলায় ‘সবুজদ্বীপের রাজা’ দেখেছিলেন। সে দিন থেকেই ‘সন্তু’র মতো সমুদ্র অভিযানে যাওয়ার শখ অনেকেরই। কিন্তু পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র ছেড়ে সে সব দ্বীপ বা সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যাওয়ার কথা খুব কম পর্যটকই ভাবেন। যদি নির্জনতা ভাল লাগে তাহলে ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবছেন যাঁরা, তাঁরা দেখে নিন কোথায় কোথায় যাবেন।
শিবরাজপুর দ্বীপ, গুজরাত
দেবভূমি দ্বারকার কাছে রয়েছে এই দ্বীপ। সমুদ্র সৈকতের কাছে একটি বাতিঘর রয়েছে যার নাম কাচ্চিগড় বাতিঘর। বিশ্বাস করা হয় যে, কাচ্চি নৌযানদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় দেওয়ার জন্য কচ্ছ বা কাতুচের শাসক, মহারাও দেশালজি এই বাতিঘর তৈরি করিয়ছিলেন। গুজরাত সরকার এই দ্বীপের উন্নয়নের জন্য এটিকে ঢেলে সাজাচ্ছেন। শিবরাজপুর সৈকত অনেকটাই আড়ালে ছিল এতদিন। এবার পর্যটনের জন্য এই দ্বীপটিকে আরও সাজানোর কাজ শুরু হয়েছে। রাজ্য সরকার জানিয়েছে, গোয়া বিচের চেয়ে কোনও অংশে কম যাবে না এই সৈকত। স্কুবা ডাইভিং, স্নরকেলিং, বোটিং-এর সুবিধা রয়েছে এই বিচে। শিবরাজপুর সমুদ্র সৈকতের কাছে আরও কিছু আকর্ষণীয় জায়গা রয়েছে যেমন—দ্বারকাধীশ মন্দির, বেট দ্বারকা, নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ ও রুক্মিনী দেবীর মন্দির।
দিউ দ্বীপ
আরব সাগরের তীরে অবস্থিত এই দ্বীপে এক সময়ে পর্তুগিজদের রাজত্ব ছিল। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য মনে থেকে যাবে অনেক দিন। দিউ দ্বীপে যাওয়ার সেরা সময় হল অক্টোবর থেকে জানুয়ারি। এখানে এলে ঘুরে দেখতে পারেন দিউ দুর্গ, গঙ্গেশ্বর মন্দির, ঝিনুকের সংগ্রহশালা এবং বহু পুরনো একটি চার্চ। এখানে একাধিক বিচ রয়েছে। তবে একটি রাত যদি বিলাসবহুল রিসর্টে কাটাতে চান, যেতে হবে নাগোয়া বিচে।
ওড়িশার গোল্ডেন বিচ
এক ঝলক দেখলে বিদেশি সৈকত বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু এই সৈকতের ঠিকানা ঘরের কাছে। ফি বছর সমুদ্রে বেড়াতে যাওয়া বাঙালির মনের অনেক কাছে রয়েছে পুরী। যদিও পুরীর এই সৈকতে ভিড় নেই। পর্যটকদের আনাগোনাও নেই।
যত দূর চোখে পড়ে শুধুই সমুদ্র ছোঁয়া হলুদ বালির চর। তার উপরে ছড়ানো ছিটানো দু-এক খানা রোদ পোহানোর ডেক চেয়ার। সঙ্গে বাহারি ছাতা। ঝকে ঝকে পরিচ্ছন্ন সৈকত। আকাশে শেষ বিকেলের রঙের খেলা মুগ্ধ করবে। পুরীর গোল্ডেন বিচ সত্যিই অনবদ্য। গত তিন বছর ধরে এই সৈকত ব্লু ফ্ল্যাগ সৈকতের মর্যাদাও বজায় রেখেছে।
কর্নাটকের কাসারকোড সৈকত
‘ব্লু ফ্ল্যাগ’ শংসাপত্র পেয়েছে এই সৈকত। অত্যন্ত শান্ত এবং নিরিবিলি জায়গা। দেশের পরিচ্ছন্ন সমুদ্র সৈকতের মধ্যে এটিও একটি। । মনোরম পরিবেশের মাঝে এই দ্বীপে সময় কাটাতে মন্দ লাগবে না আপনার!
পাদুবিদ্রি সমুদ্র সৈকত, কর্ণাটক
এটি কর্ণাটকের উডুপি জেলায় অবস্থিত। যাঁরা শান্ত সমুদ্র উপকূল নির্জনতা নিরিবিলি জায়গা পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য এই জায়গাটি উপযুক্ত। সূর্যাস্তের সময় এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব।
অন্ধ্রপ্রদেশের রুশিকোন্ডা সমুদ্র সৈকত
বিশাখাপত্তন থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে পূর্বঘাট পর্বতমালার ঢালে অবস্থিত রুশিকোন্ডা। দিগন্ত বিস্তৃত সোনালি বালি, স্বচ্ছ নীল জল মন কাড়বেই। রুশিকোন্ডা সৈকত পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণা। খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সৈকত। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর, নির্জন সৈকত। রুশিকোন্ডা সৈকত ধরেই অটো করে পৌঁছে যেতে পারেন রামকৃষ্ণ বিচ এবং ভীমা বিচ। রামকৃষ্ণ বিচের পাশেই রাখা রয়েছে সাবমেরিন আইএনএস কুরোসওয়া।
ডুবো জাহাজের ভিতরটা কেমন, তা টিকিট কেটে দেখে নিতে পারেন। রামকৃষ্ণ বিচের পাশে রয়েছে মৎসদর্শিনী। সমুদ্রের তলদেশে থাকা নাম না জানা, নানা রকম মাছেদের নিয়ে তৈরি মিউজিয়াম। এখান থেকে রোপওয়ে করে যাওয়া যায় পাহাড়ের উপর কৈলাসগিরি মন্দিরে। পাহাড়ের একেবারে উপরে পৌঁছে, সেখান থেকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখার মতো।
কেরলের কাপ্পাড বিচ
নীল আকাশের নীচে নীল সমুদ্র। দুই নীলের মাঝে দিগন্তরেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সাদা ফেলা তুলে ঢেউ আছড়ে পড়ছে সমুদ্রে। কেরলের কাপ্পাড সৈকতের সৌন্দর্যের কোনও তুলনাই হয় না। তার সঙ্গেই পাল্লা দিতে পারে এখানকার নিরাপত্তা। অনেকেই এই সৈকতকে দেশের সবচেয়ে নিরাপদ সৈকত বলে থাকেন। এই সৈকতটিও ব্লু ফ্ল্যাগ পেয়েছে। কাপ্পাড বিচে ওয়াটার স্পোর্টস্-এর কোনও তুলনা হয় না।
ইডেন বিচ
পন্ডিচেরিতে রয়েছে এক ডজনেরও বেশি সুন্দর সৈকত। আর সেই সব সৈকতের কথা উঠলে উঠে আসে ইডেন বিচের নাম। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এই সৈকত যেমন শীর্ষে রয়েছে তেমনই এটি মহিলাদের জন্য নিরাপদ। এটিও ব্লু ট্যাগ সার্টিফাইড। ২০২১ সালে ইডেন বিচ ব্লু ফ্ল্যাগ সম্মান পায়। ৮০০ মিটার বিস্তৃত এই দ্বীপ পরিচ্ছন্ন, এখানে রয়েছে ওয়েস্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম।
কোভালাম সৈকত
এটি কোভেলং সমুদ্র সৈকত নামে পরিচিত। এখানকার মনোরম দৃশ্যের টানে দূর দূরান্তে থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসেন। তামিলনাড়ু চেন্নাই থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে এই সৈকত।
কোভালাম আরব সাগরের তিরে কেরলের একটি ছোট সৈকত শহর৷ কোভালাম কথাটার মানে নারকেল গাছের বন৷ এই সমুদ্র সৈকত সত্যিই নারকোল গাছে ছাওয়া৷ কোভালাম এক সময় ছিল সমুদ্রের ধারে নির্জন একটি গ্রাম যেখানে প্রধানত মত্স্যজীবীরাই বসবাস করতেন৷ ১৯৩২ সালে ত্রিবাঙ্কোরের মহারানি সেথু লক্ষ্মীবাঈ এখানে তাঁদের নিজস্ব একটি রিসর্ট তৈরি করার পর এটি সবার নজরে আসে৷ তারপর সত্তরের দশক থেকে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে কোভালামের সমুদ্র সৈকতে৷ ক্রমশ এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় টুরিস্ট ডেস্টিনেশন হয়ে ওঠে৷ কোভালামের সমুদ্র সৈকত সতেরো কিলোমিটার দীর্ঘ, আকারে এক ফালি চাঁদের মতো৷ মাঝে মাঝে এবড়ো খেবড়ো পাহাড় এই বিচকে তিন টুকরো করেছে। কোভালাম বলতে এই তিনটে বিচকেই বোঝায়।
আন্দামানের রাধানগর সৈকত
এশিয়া এবং বিশ্বের সবচেয়ে মনোরম সমুদ্র সৈকতগুলোর মধ্যে রাধানগর সমুদ্রসৈকত একটি। দেশি বিদেশি পর্যটকেরা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য এখানে ছুটে আসেন। দেশে যে এতো সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সমুদ্র সৈকত আছে তা আমাদের অনেকেরই অজানা। বেড়াতে বেরিয়ে যাঁরা ভিড়ভাট্টা থেকে একেবারে দূরে থাকা পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য আদর্শ। এখানেও বেড়াতে যাওয়ার সেরা সময় নভেম্বর থেকে এপ্রিল।
লাক্ষাদ্বীপ
ভারতের ক্ষুদ্রতম কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি হয়েছে ৩৬টি আলাদা আলাদা দ্বীপ নিয়ে। মোট আয়তন ৩২ বর্গ কিলোমিটার।এত দিন সেই জায়গা সম্বন্ধে সকলের কমবেশি জানা থাকলেও, বছরে খুব কম ভারতীয়েরই পা পড়ত সেখানে। মালয়ালম এবং সংস্কৃতে লাক্ষদ্বীপ কথার অর্থ লক্ষ দ্বীপের সমন্বয়। এই দ্বীপপুঞ্জ পশ্চিমে আরব সাগর এবং পূর্বে লক্ষদ্বীপ সাগরের মধ্যে সামুদ্রিক সীমানা হিসেবে কাজ করে। উজ্জ্বল নীলাভ সবুজ লাগুন পরিবৃত প্রবাল দ্বীপ যেন পান্নার খণ্ডের মতো। আরব সাগরের ঘন নীল জলের বুকে জেগে রয়েছে লাক্ষাদ্বীপ। কোচি থেকে উড়ে আসা বিমান প্রায় সমুদ্রের জল ছুঁয়ে ল্যান্ড করে। বিমানবন্দরের প্রস্থ সাকুল্যে ১০০ মিটার মতো। তার দু’পাশে বেলাভূমির সাদা ধবধবে বালি সূর্যের আলোয় চিকচিক করে। বেলাভূমির পরেই লাগুন। লাগুনের টলটলে জলের সেই উজ্জ্বল নীলাভ সবুজ রং মন মাতিয়ে দেয়। লাগুন থেকে চোখ সরিয়ে দ্বীপের ভেতরের দিকে তাকালে দেখা যাবে সারি সারি নারকেল গাছ। লাক্ষাদ্বীপের ৩৬টির মধ্যে ১০টি দ্বীপে জনবসতি আছে। বাকিগুলো জনমানব শূন্য।
লক্ষদ্বীপে এখনও পর্যন্ত মোট চারটি দ্বীপে পর্যটকদের থাকার বন্দোবস্ত করা গিয়েছে। কাদমত, কাভারাত্তি, বাঙ্গারাম এবং ঠিন্নাকারা। আগাত্তি দ্বীপ থেকে এই চারটি দ্বীপে যাওয়ার একমাত্র উপায় দ্রুতগতি সম্পন্ন নৌকা। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত কাদমত দ্বীপটি লম্বায় প্রায় আট কিলোমিটার, কিন্তু খুবই সরু। এর সব থেকে চওড়া অংশের প্রস্থ ২০০ মিটার। পশ্চিম দিকের লাগুন খুবই চওড়া ও অগভীর। কাদমত দ্বীপে বালির রং মুখ্যত সাদা হলেও একটু হাল্কা গোলাপি আভা দেখা যায়। সমুদ্র সৈকতে মাঝে মাঝে চেয়ার ও ছাতা বিছানো। রয়েছে প্রচুর নারকেল গাছ, ঝাউ গাছ, মাঝে মাঝে কিছু ঘাসও। লোকজন বিশেষ নেই বললেই চলে। মলদ্বীপ থেকে চোখ ফিরিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা ঘুরে আসতেই পারেন লাক্ষাদ্বীপে।